খাবারেররঙের নামে আমরা যেভাবে পোকা খাচ্ছি
ভুলক্রমেকোনো পোকা মুখের ভেতরে গেলে কী বীভৎস একঅভিজ্ঞতাই না হয়! অথচআমরা দীর্ঘদিন ধরে এমন সব খাবার খাচ্ছি, এমন সব পণ্য ব্যবহারকরছি, যেগুলো রাঙাতে সরাসরি পোকা ব্যবহার করা হয়। জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিত...
সুস্বাদু রেড ভেলভেট কেকের লাল রং আসে বিশেষ এক পোকা থেকে
রেস্তোরাঁয়বসেছেন খেতে। দু-তিন লোকমাভাত মুখে দিয়ে আয়েশে চিবোচ্ছেন। শর্ষে ইলিশটা বেশ লাগছে। ভাতের সঙ্গে ঝোল মাখাতে মাখাতে হঠাৎ খেয়াল করলেন, সাদা ভাতের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে কুচকুচে কালো রঙের কিছু একটা। ভালো করে পরখ করতেই বুঝলেন, কালো বস্তুটি আর কিছু নয়, পোকা! ব্যস, খাবারটা গলায় আটকে গেল। দুই হাতে প্লেট সরিয়ে দৌড় দিলেন বেসিনের দিকে। কেউ কেউ তো বেসিনের দিকেদৌড়ানোর সময়টুকুও পান না! পেটের নাড়িভুঁড়িও উল্টে আসে কারও কারও। মোটকথা, খাবারে পোকা মানেই চূড়ান্ত বিরক্তিকর এবং বীভৎস এক ব্যাপার। কিন্তুজেনে রাখুন, আমরা প্রতিনিয়ত এমন কিছু খাবার খাই কিংবা এমন কিছু পণ্য ব্যবহার করি, যেসব তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ওই পোকা!
কেবল কেক নয়, আরও অনেকে খাবার রাঙাতেই ব্যবহৃত হয় ওই বিশেষ পোকাছবি: সংগৃহীত
রেডভেলভেট কেকের কথাই ধরা যাক। নামটি শুনলেই অনেকের জিবে জল এসে যায়।এই কেকের লাল রং তৈরি হয়একধরনের পোকা বা কীট থেকে! গা গুলিয়ে উঠল? তাহলে শুনুন, মুখরোচক আরও অনেক ধরনের খাবার, যেমন চকলেট, আইসক্রিম, দই, জেলি, জুস, ডোনাট তৈরিতেও যে রং ব্যবহৃতহয়, তা আসে মূলতএক বিশেষ পোকা থেকে। শুধু খাবার নয়, লিপস্টিক, আইশ্যাডো, শ্যাম্পু, লোশনের মতো প্রসাধনে ব্যবহৃত রংও আসে ওই পোকা থেকে!
কীসে পোকা?
স্ত্রীকোচিনিয়েলের অঙ্কীয়দেশ ও পৃষ্ঠদেশ
স্ত্রী কোচিনিয়েলের অঙ্কীয়দেশ ও পৃষ্ঠদেশ ছবি: সংগৃহীত
খাবারও প্রসাধনসামগ্রীতে ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় লাল রঙের নাম কারমাইন। এটি মূলত কোচিনিয়েল বা কোচিনিল নামেএকধরনের পোকাকে পিষে প্রস্তুত করা হয়। বিশ্বব্যাপী কারমাইনের অসম্ভব চাহিদার কারণে লাতিন আমেরিকায়, বিশেষত পেরুতে বিশাল অঞ্চলজুড়ে কোচিনিয়েলের চাষ করা হয়। বিশ্বে কারমাইনের মোট জোগানের ৯৫ শতাংশই আসেএই দেশ থেকে।
গোড়ারদিকে কারমাইন মূলত সুতা রাঙাতেই ব্যবহৃত হতো
গোড়ার দিকে কারমাইন মূলত সুতা রাঙাতেই ব্যবহৃত হতোছবি: পেক্সেলস
বিশ্বব্যাপীখাদ্যশিল্পে কারমাইনের অত্যধিক চাহিদা। দই, ফল থেকে তৈরিপিঠা, কোমল পানীয়, কেক, ডোনাটে এই রং ব্যবহারকরা হয়। কারমাইনের জনপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে, এই রং সহজেনষ্ট হয় না। দীর্ঘদিনে, এমনকি কড়া রোদেও এটি খাবারের স্বাদে কোনো পরিবর্তন আনে না।
বোতলে কারমাইন (বাঁয়ে), কোচিনিয়েল পোকায় ঘষা দেওয়ার পর আঙুল হয়েছে রক্তবর্ণ
বোতলেকারমাইন (বাঁয়ে), কোচিনিয়েল পোকায় ঘষা দেওয়ার পর আঙুল হয়েছেরক্তবর্ণ
বোতলেকারমাইন (বাঁয়ে), কোচিনিয়েল পোকায় ঘষা দেওয়ার পর আঙুল হয়েছেরক্তবর্ণছবি: উইকিমিডিয়া কমনস ও হিউস্টন মিউজিয়ামঅব ন্যাচারাল হিস্ট্রি
৫০০বছরের বেশি আগে খাবারের এই রং ব্যবহারেরশুরু। অনেকে মনে করেন, কৃত্রিম রঙের চেয়ে এটি অনেক বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। কিন্তু অনেকে মনে করেন, যেসব পণ্যে কারমাইন ব্যবহার করা হয়, সেসব পণ্যের গায়ে সেটি স্পষ্ট করে লেখা থাকা উচিত। বেশির ভাগ সময়ই পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি ‘কারমাইন’ না লিখে ‘প্রাকৃতিকলাল রং’, ‘ক্রিমসন লেক’, ‘ই১২০’, ‘প্রাকৃতিক রং’ ইত্যাদি লেখে। আবার এখন বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকেও এমন রং সংগ্রহ করাযায়, যা খাবারে ব্যবহারযোগ্যএবং যেগুলোর সঙ্গে কোনো পোকা বা কীটের সম্পর্কনেই। যেমন বিটানিন নামে যে খাবারের রংব্যবহৃত হয়, সেটি তৈরি হয় বিটের মূলথেকে।
‘আপারফেক্ট রেড’ বইয়ের প্রচ্ছদ
‘আ পারফেক্ট রেড’ বইয়ের প্রচ্ছদ কোলাজ: একটু থামুন
কারমাইনও এর ইতিহাস নিয়েআ পারফেক্ট রেড নামের একটি বই লিখেছেন এমিবাটলার গ্রিনফিল্ড। এই মার্কিন লেখকমনে করেন, পণ্যে যদি কারমাইন ব্যবহার করা হয়, তাহলে তার প্যাকেটে সেটি স্পষ্ট করে বলা উচিত। তাঁর ভাষায়, ‘খাবারের রং হিসেবে কারমাইনদারুণ এক পণ্য এবংএটি গোলাপি, বেগুনি, কমলা, লাল ইত্যাদি রং তৈরিতে ব্যবহৃতহয়। কিছু মানুষের হয়তো এই রঙের প্রতিঅ্যালার্জি আছে, কিন্তু আদতে এর কার্যকারিতা বেশভালো।’
নোপাল ক্যাকটাসে কোচিনিয়েল চাষের জন্য বসানো হয়েছে জ্যাপোটেক নেস্ট (বাঁয়ে),
১৭৭৭ সালের চিত্রকর্মে কোচিনিয়েল আহরণের দৃশ্য
নোপালক্যাকটাসে কোচিনিয়েল চাষের জন্য বসানো হয়েছে জ্যাপোটেক নেস্ট (বাঁয়ে), ১৭৭৭ সালের চিত্রকর্মে কোচিনিয়েল আহরণের দৃশ্যছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
কোচিনিয়েলপোকাটি লম্বায় ৫ মিলিমিটার থেকেশূন্য দশমিক ২ ইঞ্চি পর্যন্তহতে পারে। পুরুষ কোচিনিয়েলের পাখা আছে এবং উড়তে পারে। কিন্তু স্ত্রী কোচিনিয়েলের পাখা নেই, উড়তেও পারে না। কারমাইন তৈরির জন্য মূলত স্ত্রী কোচিনিয়েলই ব্যবহৃত হয়।
পুরুষকোচিনিয়েলের পাখা আছে (বাঁয়ে), শুকনো স্ত্রী কোচিনিয়েল
রংতৈরি হয় মূলত পোকায়থাকা কারমাইনিক অ্যাসিড থেকে। কোচিনিয়েলকে কয়েক ধাপে শুকিয়ে রং তৈরি করাহয়। এই ধাপগুলো চূড়ান্তঅবস্থায় পৌঁছানোর আগে শুধু রংটুকু রেখে পোকার শরীরের পুরো অংশই বাদ দেওয়া হয়।
প্রাকৃতিকভাবেক্যাকটাসের গায়ে বাসা বেঁধেছে কোচিনিয়েল পোকা
কোচিনিয়েলনিরাপদ নাকি অনিরাপদ, তা এককথায় বলাযায় না। তবে এটি স্বাস্থ্যকর বলা যেতে পারে। এই পোকা থেকেসংগৃহীত উপাদানে খুব অল্পসংখ্যক মানুষের অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। এ কারণেই মূলতকারমাইন ব্যবহৃত পণ্যের গায়ে স্পষ্ট করে তা উল্লেখ করাবাধ্যতামূলক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন(এফডিএ)।
পরীক্ষাগারেকোচিনিয়েল ‘নন–টক্সিক’ বা‘অবিষাক্ত’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অধিকাংশ মানুষের জন্য এই পোকা কোনোসমস্যার কারণ নয়।
খাবারেপোকা থাকবেই
পোকারকথা ভেবে প্রিয় খাবার না খাওয়া কিঠিক হবে?
পোকারকথা ভেবে প্রিয় খাবার না খাওয়া কিঠিক হবে?
রোজকারজীবনে আমাদের খাবারে বহু পোকা বা কীট থাকেনানাভাবে। এফডিএ এটা জানে, কিন্তু তারপরও সেসব খাবার প্রস্তুত ও বাজারজাতকরণে কোনোবাধা দেয় না। খাবারে পোকার ব্যবহার মানেই তা অনিরাপদ, ব্যাপারটাতেমন নয়। পোকা বা কীটের ব্যাপারটাজানলে অনেকের হয়তো অরুচি জন্মায়। তবে যেকোনো খাবার সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাজারজাত করার প্রক্রিয়ায় একাধিক ধাপে অনেক মানুষ কাজ করেন। তাঁরা সবাই যে সব সময়যথাযথ ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়েকাজ করে করেন, সেটাও তো নয়। হয়তোএসব বিবেচনায় নিয়েই এফডিএ খাবারে নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত পোকা বা কীটপতঙ্গ ব্যবহারেরঅনুমোদন দেয়।
শেষকথা হলো, এর পর থেকেরেড ভেলভেট কেক খাওয়ার আগে হয়তো কোচিনিয়েল পোকাটির কথা আপনার মনে পড়বে, তবে একে খাবার হিসেবেই মেনে নিন। তালিকা থেকে প্রিয় খাবারের নাম বাদ দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না!
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, সায়েন্স ডিরেক্ট ও ডিএক্স
0 Comments